ইসলামী ব্যাংকে চাকরির জোয়ার: ২ পদে দেড় লাখ আবেদন! আঁধারের পর ফিরছে কি স্বচ্ছতা?

After years of controversial hiring, Islami Bank returns to competitive exams, signaling a potential new era of meritocracy.

2 264

বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের মাত্র দুটি পদে চাকরির জন্য আবেদন জমা পড়েছে প্রায় দেড় লাখ! হ্যাঁ, সংখ্যাটা ঠিকই পড়ছেন—১ লাখ ৪৬ হাজার। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের ‘ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার’ ও ‘ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ)’ পদের জন্য এই বিপুল সংখ্যক প্রার্থী আবেদন করেছেন।

যারা আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতের খবর রাখছি, তাদের কাছে এটি শুধু একটি সাধারণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নয়। এটি তার চেয়ে অনেক বড় কিছু। এই সংখ্যাটি কেবল দেশের চাকরির বাজারের ভয়াবহতা বা ব্যাংকিং পেশার প্রতি তরুণদের আগ্রহকেই বোঝায় না; এটি একটি বিতর্কিত অতীত পেরিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার একটি সূক্ষ্ম পরীক্ষাও বটে।

একটা সময় ছিল যখন এই ব্যাংকটির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিবর্তন এবং দীর্ঘ বিরতির পর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের এই উদ্যোগে বিপুল সাড়া মিলল।

তাহলে প্রশ্ন হলো, এই দেড় লাখ আবেদন কি কেবলই একটি চাকরির আশায়, নাকি ইসলামী ব্যাংকের প্রতি তরুণদের আস্থার পুনরুত্থান? চলুন, এই খবরের গভীরে যাওয়া যাক।

এই লেখায় যা জানবেন

  • বিপুল আবেদনের পেছনের আসল কারণ কী?
  • ইসলামী ব্যাংকের বিতর্কিত অতীত ও এস আলম অধ্যায়।
  • নতুন ম্যানেজমেন্টের অধীনে কী পরিবর্তন আসছে?
  • চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এর অর্থ কী এবং পরীক্ষা কবে?

পদের তুলনায় আবেদনের এই বিস্ফোরণ কেন?

সত্যি বলতে, দুটি এন্ট্রি-লেভেল পদের জন্য দেড় লাখ আবেদন যেকোনো মানদণ্ডেই বিস্ময়কর। ব্যাংকটি যদিও পদের সংখ্যা প্রকাশ করেনি, তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার জনকে ধাপে ধাপে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। সেই হিসাবেও প্রতিযোগিতা তীব্র।

এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:

১. দীর্ঘ বিরতির পর উন্মুক্ত নিয়োগ

ইসলামী ব্যাংক দেশের অন্যতম বৃহত্তম একটি ব্যাংক। কিন্তু গত কয়েক বছর, বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়, ব্যাংকটির উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ ছিল বললেই চলে। দীর্ঘদিন পর যখন সবার জন্য উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগের ঘোষণা এলো, তখন পুঞ্জীভূত চাকরিপ্রার্থীরা একযোগে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।

২. ব্যাংকিং পেশার প্রতি অটুট আগ্রহ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং এখনও তরুণ-তরুণীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশার তালিকায় শীর্ষে। সামাজিক মর্যাদা, স্থিতিশীল বেতন কাঠামো এবং নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট প্রতি বছর এই সেক্টরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ইসলামী ব্যাংকের এই পদ দুটি (TAO এবং TAO Cash) ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু করার জন্য আদর্শ এন্ট্রি পয়েন্ট।

৩. স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা?

সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটি। এইবারের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে হচ্ছে। এটি চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে যে, এবার হয়তো মেধার মূল্যায়ন হবে। অতীতের ‘ফোন কল’ বা ‘সুপারিশ’-এর সংস্কৃতির বদলে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের এই সিদ্ধান্তই আবেদনের এই বিস্ফোরণের মূল অনুঘটক হতে পারে।

একসময়ের বিতর্কিত নিয়োগ: এস আলম অধ্যায়ের সেই ছায়া

আজকের এই দেড় লাখ আবেদনের খবরটি বুঝতে হলে আমাদের কয়েক বছর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। যারা ব্যাংকিং খাতের খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, বিগত সরকারের শেষ প্রায় আট বছর ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিল।

সেই সময়টা ছিল ব্যাংকটির জন্য বেশ সমালোচিত। অভিযোগ আছে, ওই সময় ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য যেমন খারাপ হয়েছিল, তেমনি এর মানবসম্পদ বিভাগেও নেমে এসেছিল বিপর্যয়

পরীক্ষা ছাড়াই ১০,৮৩৪ কর্মী নিয়োগ!

তথ্য বলছে, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার ৮৩৪ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, অভিযোগ রয়েছে—এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর প্রায় কাউকেই কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক বা লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়নি।

  • আঞ্চলিকতার অভিযোগ: নিয়োগ পাওয়া এই কর্মীদের মধ্যে একটি বড় অংশ, প্রায় ৭ হাজার ২২৪ জনই ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার।
  • নির্দিষ্ট উপজেলা: আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, এই ৭ হাজারের মধ্যে আবার এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের নিজ উপজেলা পটিয়ার বাসিন্দাই ছিলেন ৪ হাজার ৫২৪ জন।

একজন ক্যারিয়ার রিপোর্টার হিসেবে বলতে পারি, একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এমন নজিরবিহীন আঞ্চলিক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিকেই দুর্বল করে দেয়। কোনো ধরনের নিয়মনীতি বা মেধা যাচাই ছাড়াই নিয়োগ পাওয়া এই কর্মীদের নিয়ে ব্যাংকটি যে পরবর্তীকালে বেকায়দায় পড়বে, তা অনুমিতই ছিল।

নতুন পর্ষদ ও “স্বচ্ছতার” পথে হাঁটা

২০২৪ সালের আগস্টে সরকারের পতনের পর ব্যাংকিং খাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা ব্যাংক থেকে সরে যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়োগ দেয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। নতুন পর্ষদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি: ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা এবং এর মানবসম্পদ বিভাগে জমে থাকা জঞ্জাল পরিষ্কার করা।

৪ হাজার কর্মীর ছাঁটাই ও তার প্রভাব

পর্ষদ পুনর্গঠনের পর, ব্যাংকটি থেকে প্রায় চার হাজার কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এদের বেশিরভাগই পূর্বের বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছিলেন। এই গণছাঁটাইয়ের ফলে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় জনবল সংকট তৈরি হয়, যা পূরণের জন্যই আজকের এই নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরু।

2 Comments
  1. […] যেকোনো শাখা/অফিস। এই আর্টিকেলে ইসলামী ব্যাংক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৫– এর সকল বিস্তারিত তথ্য, যোগ্যতা, […]

  2. […] বাস্তব ব্যাটারি পারফরম্যান্স পরীক্ষা সাপেক্ষ। এবং ‘AI ক্যামেরা’ একটি […]

Leave A Reply

Your email address will not be published.